https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

বিজ্ঞাপনে এক টাকাও খরচ না করে প্রথম ১০০ কাস্টমার পাবেন যেভাবে (বিনা খরচে মার্কেটিং-এর কমপ্লিট গাইড)

top-news
  • 04 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

শূন্য পকেটে ব্যবসার শুরু

বাংলাদেশে এখন স্টার্টআপ আর এফ-কমার্স (F-Commerce) ব্যবসার জোয়ার চলছে। ছাত্রজীবনে টিউশনির টাকা জমিয়ে বা চাকরির পাশাপাশি অনেকেই নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে চায়। কিন্তু ব্যবসার শুরুতে সবচেয়ে বড় যে বাধাটা আসে, তা হলো—‘বাজেট’। প্রডাক্ট সোর্সিং বা ওয়েবসাইট বানাতেই যখন সব টাকা শেষ, তখন মার্কেটিং বা বিজ্ঞাপনের জন্য পকেটে আর কিছুই থাকে না।

অনেকেই ভাবেন, ফেসবুকে বুস্ট না করলে বা পেপারে বিজ্ঞাপন না দিলে বুঝি বিক্রি হয় না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং সত্যটা হলো, শুরুর দিকের কাস্টমাররা বিজ্ঞাপন দেখে আসে না, তারা আসে ‘বিশ্বাস’ থেকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষ অপরিচিত ব্র্যান্ডের চেয়ে পরিচিত মানুষের সুপারিশকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

আজকের এই গাইডলাইনে আমরা ধাপে ধাপে আলোচনা করব, কীভাবে আপনি আপনার বুদ্ধি, শ্রম এবং কৌশলে—কোনো টাকা খরচ না করেই—আপনার প্রথম ১০০ জন কাস্টমার জোগাড় করবেন। এটা কোনো জাদুর কাঠি নয়, এটা হলো পিওর ‘হাসল’ (Hustle)।

ধাপ ১: আপনার ‘ওয়ার্ম মার্কেট’ বা পরিচিত বলয় ব্যবহার করুন

ব্যবসার শুরুতে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আপনার নেটওয়ার্ক। এটাকে মার্কেটিংয়ের ভাষায় বলে ‘Warm Market’। আপনার বন্ধু, পরিবারের সদস্য, কাজিন, প্রাক্তন সহকর্মী—এরাই আপনার প্রথম কাস্টমার হওয়ার সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।

১. লজ্জা ভাঙুন: বাঙালি হিসেবে আমাদের একটা অযথা লজ্জা থাকে। “বন্ধুকে বলব আমার শাড়ি কিনতে? বা কাজিনকে বলব আমার সার্ভিস নিতে?”—এই ইগো ঝেড়ে ফেলুন। আপনি যদি আপনার পণ্য নিয়ে গর্বিত হন, তবে সেটা সবাইকে জানাতে লজ্জা কেন?
২. পার্সোনাল মেসেজ: ফেসবুকে একটা ঢালাও স্ট্যাটাস দিয়ে বসে থাকবেন না। আপনার কাছের ৫০-১০০ জন মানুষকে পার্সোনালি মেসেজ দিন বা কল করুন। তাদের বলুন, “দোস্ত/ভাইয়া, আমি এই নতুন উদ্যোগটা নিয়েছি। তোরা আমার আপন মানুষ, তোদের ফিডব্যাক আমার খুব দরকার। তোরা যদি একবার ট্রাই করতি, খুব উপকার হতো।”
৩. ডিসকাউন্ট নয়, ভ্যালু দিন: তাদের কাছে পণ্য বেচবেন না, সাহায্য চান। যখন তারা দেখবে আপনি তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তারা খুশি হয়ে কিনবে। এবং মনে রাখবেন, এরা আপনাকে টাকা দিয়ে কিনলেই সেটা আসল ‘ভ্যালিডেশন’।

ধাপ ২: ফেসবুক গ্রুপ—বাংলাদেশের সোনার খনি

বাংলাদেশে ফেসবুক গ্রুপগুলো এখন সোশ্যাল মিডিয়ার চেয়েও শক্তিশালী কমিউনিটি। এখানে মানুষ আড্ডা দেয়, পরামর্শ নেয় এবং কেনাকাটা করে।

১. সঠিক গ্রুপ নির্বাচন: আপনার পণ্য যদি মেয়েদের পোশাক হয়, তবে ‘Women and e-Commerce’ বা এই ধরণের গ্রুপগুলো আপনার জায়গা। যদি গ্যাজেট হয়, তবে টেক লাভারদের গ্রুপে যান।
২. সেলস পোস্ট নিষিদ্ধ: হুট করে গ্রুপে জয়েন করেই “আমার পণ্য কিনুন” টাইপ পোস্ট দেবেন না। এতে এডমিন আপনাকে ব্যান করবে এবং মেম্বাররা বিরক্ত হবে।
৩. এক্সপার্ট হিসেবে নিজেকে তুলে ধরুন: ধরুন আপনি অর্গানিক মধু বিক্রি করেন। আপনি পোস্ট দিন— “কীভাবে আসল মধু চিনবেন?” বা “মধুর ৫টি অজানা গুণ”। নিচে ছোট করে লিখুন, “আমি খাঁটি মধু সোর্স করি, বিস্তারিত জানতে ইনবক্স করুন।” এতে মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করবে। এই বিশ্বাসই সেলস জেনারেট করবে।
৪. কমেন্ট মার্কেটিং: অন্যের পোস্টে প্রাসঙ্গিক কমেন্ট করুন। কেউ যদি গ্রুপে জানতে চায়, “ভালো মানের চামড়ার ওয়ালেট কোথায় পাব?” সেখানে গিয়ে সুন্দর করে আপনার পণ্যের ছবিসহ কমেন্ট করুন।

ধাপ ৩: কন্টেন্ট ইজ কিং (রিলস এবং টিকটক)

এখন মানুষের পড়ার চেয়ে দেখার আগ্রহ বেশি। আর অর্গানিক রিচ পাওয়ার জন্য রিলস (Reels) বা টিকটক (TikTok)-এর কোনো বিকল্প নেই। ফেসবুকে এখন নরমাল পোস্টের রিচ কমিয়ে দিলেও, রিলসের রিচ প্রচুর।

১. বিহাইন্ড দ্য সিন (Behind the Scene): মানুষ পণ্য দেখার চেয়ে পণ্যের পেছনের গল্প দেখতে পছন্দ করে। আপনি কীভাবে পণ্য প্যাকেট করছেন, কীভাবে সোর্স করছেন—এসবের ছোট ছোট ভিডিও দিন।
২. স্টোরি টেলিং: ইমোশনাল কানেকশন তৈরি করুন। “কেন আমি এই ব্যবসা শুরু করলাম”, “প্রথম অর্ডারের অনুভূতি”—এই গল্পগুলো মানুষকে আপনার ব্র্যান্ডের প্রতি দুর্বল করে।
৩. ধারাবাহিকতা: প্রতিদিন অন্তত একটা রিল বা ভিডিও আপলোড করুন। শুরুতে ভিউ হবে না, কিন্তু অ্যালগরিদম যখন বুঝবে আপনি সিরিয়াস, তখন যেকোনো একটা ভিডিও ভাইরাল হবেই। আর বাংলাদেশে একটা ভিডিও ভাইরাল হওয়া মানেই রাতারাতি কয়েক হাজার ফলোয়ার।

ধাপ ৪: কোল্ড আউটরিচ বা অপরিচিত মানুষকে মেসেজ

আপনার পরিচিতদের বাইরেও বিশাল একটা জগত আছে। লিংকডইন (LinkedIn) বা ইনস্টাগ্রামে আপনার পটেনশিয়াল কাস্টমারদের খুঁজে বের করুন।

১. স্প্যামিং করবেন না: কপি-পেস্ট মেসেজ সবাইকে পাঠাবেন না। যাকে মেসেজ দিচ্ছেন, তার প্রোফাইল একটু ঘেঁটে দেখুন।
২. সমস্যার সমাধান: মেসেজে বলুন, “ভাইয়া, আমি দেখেছি আপনি ফুড ব্লগিং করেন। আমাদের নতুন হোমমেড সসটা আপনার রান্নায় একটা আলাদা টুইস্ট আনতে পারে। আমি কি স্যাম্পল পাঠাব?”
৩. ফলো-আপ: প্রথম মেসেজে রিপ্লাই না পেলে রাগ করবেন না। ৩-৪ দিন পর ভদ্রভাবে আরেকবার নক দিন। মনে রাখবেন, মানুষ ব্যস্ত থাকে, তাই রিমাইন্ডার দেওয়া জরুরি।

ধাপ ৫: রেফারেল সিস্টেম চালু করুন

আপনার প্রথম ৫ জন কাস্টমারই আপনার পরবর্তী ৫০ জন কাস্টমার এনে দিতে পারে। এটাকে বলে ওয়ার্ড অফ মাউথ (Word of Mouth)।

১. অফার দিন: আপনার কাস্টমারকে বলুন, “আপু, আপনি যদি আপনার কোনো বন্ধুকে রেফার করেন এবং সে যদি কেনে, তবে আপনার নেক্সট অর্ডারে ১০% ছাড় অথবা একটা গিফট পাবেন।”
২. রিভিউ বা ফিডব্যাক: কাস্টমার পণ্য পাওয়ার পর তাকে কল দিয়ে ফিডব্যাক নিন। যদি সে খুশি হয়, তাকে অনুরোধ করুন তার প্রোফাইলে বা আপনার পেজে একটা রিভিউ দিতে। বাংলাদেশে মানুষ রিভিউ দেখে পণ্য কেনে। একটা পজিটিভ ভিডিও রিভিউ হাজার টাকার বিজ্ঞাপনের চেয়ে বেশি কাজ দেয়।

ধাপ ৬: ফ্রি স্যাম্পলিং বা বার্টার সিস্টেম

শুরুতে কিছু পণ্য ফ্রিতে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এটাকে লস ভাববেন না, এটা ইনভেস্টমেন্ট।

১. মাইক্রো-ইনফ্লুয়েন্সার: যাদের ফলোয়ার ৫-১০ হাজার, কিন্তু এনগেজমেন্ট খুব ভালো—এমন ইনফ্লুয়েন্সারদের খুঁজুন। তাদের বলুন, “আমি আপনাকে আমার প্রোডাক্টটা গিফট করতে চাই, ভালো লাগলে একটা স্টোরি দিয়েন।” বড় সেলিব্রিটিরা টাকা চাইবে, কিন্তু ছোটরা পণ্যের বিনিময়েই খুশি হয়।
২. কর্পোরেট গিফটিং: আপনার পণ্য যদি অফিসিয়াল বা স্টেশনারি আইটেম হয়, তবে বিভিন্ন অফিসের এইচআর-এর সাথে যোগাযোগ করে কিছু স্যাম্পল দিয়ে আসুন।

ধাপ ৭: বিটুবি (B2B) পার্টনারশিপ

একা বড় হওয়া কঠিন, তাই অন্যের কাঁধে ভর দিন। এমন কোনো ব্যবসার সাথে পার্টনারশিপ করুন যারা আপনার প্রতিযোগী নয় কিন্তু তাদের কাস্টমার বেস আপনার মতোই।

উদাহরণ: আপনি যদি হাতে বানানো গয়না বিক্রি করেন, তবে যারা শাড়ি বিক্রি করে তাদের সাথে কথা বলুন। তাদের বলুন, “আপনার কাস্টমার যখন শাড়ি কিনবে, তাদের আমার গয়নার একটা কুপন দেবেন। বিনিময়ে আমি আমার কাস্টমারদের আপনার পেজের কথা বলব।” এতে উভয়ের লাভ।

ধাপ ৮: কাস্টমার সার্ভিসই সেরা মার্কেটিং

বাংলাদেশে কাস্টমার সার্ভিসের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাই আপনি যদি এখানে একটু ভালো করেন, মানুষ মনে রাখবে।

১. দ্রুত রেসপন্স: মেসেজ আসার ৫ মিনিটের মধ্যে রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করুন।
২. বিক্রির পরেও খোঁজ নেওয়া: পণ্য ডেলিভারি হওয়ার পর খোঁজ নিন সবকিছু ঠিক আছে কিনা। এই ছোট যত্নটুকু কাস্টমারকে আপনার পার্মানেন্ট ফ্যান বানিয়ে দেবে।
৩. সততা: ডেলিভারিতে দেরি হলে বা পণ্যে সমস্যা থাকলে মিথ্যা অজুহাত দেবেন না। সত্য বলে ক্ষমা চান। বাঙালিরা সততা খুব পছন্দ করে।

ধাপ ৯: লোকাল এসইও এবং মার্কেটপ্লেস

শুধু ফেসবুকের ওপর ভরসা করবেন না।

১. গুগল মাই বিজনেস: আপনার ব্যবসার নাম গুগলে রেজিস্টার করুন। কেউ যখন ‘best cake shop near me’ লিখে সার্চ দেবে, যেন আপনাকে পায়।
২. বিক্রয় ডট কম বা দারাজ: এসব সাইটে ফ্রিতে পণ্য লিস্টিং করা যায়। এখান থেকে প্রচুর অর্গানিক ট্রাফিক পাওয়া সম্ভব।

উপসংহার

প্রথম ১০০ জন কাস্টমার পাওয়া হলো একটা রকেটের অভিকর্ষ বল কাটিয়ে মহাকাশে যাওয়ার মতো। শুরুতে জ্বালানি (শ্রম) বেশি লাগে, গতি কম থাকে। কিন্তু একবার ১০০ জন কাস্টমার হয়ে গেলে, তাদের মাধ্যমেই পরবর্তী ১০০০ জন আসবে।

টাকা না থাকলে মেধা খাটান। ধৈর্য ধরুন। মনে রাখবেন, আজকের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো—যেমন পাঠাও বা চালডাল—একদিন ছোট থেকেই শুরু হয়েছিল। তাদেরও শুরুতে বিজ্ঞাপনের বাজেট ছিল না, ছিল অদম্য সাহস আর কৌশল। আপনার পণ্য যদি ভালো হয় এবং আপনি যদি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন, তবে টাকা খরচ না করেও সফল হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শুভকামনা আপনার নতুন যাত্রার জন্য!

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *